Sunday, March 8, 2020

দোল, ২০২০/১৪২৬

পুড়লো ন্যাড়া উড়লো আগুন
ঢাকলো ধোঁয়া জোছনাটাকে
রঙের ফেরে শুকোচ্ছে বুক
লাগছে ফিকে আয়নাটাকে

আজকে তবে বিবর্ণ হক
দিক রাঙানো ভালবাসা
ফিরবে তবেই রঙ এ বুকে
ভরবে আলোয় সবার আশা

আজকে তবে স্বচ্ছ রঙে
শ্বাস ভরা হাত থাকুক হাতে
জলের বর্ণে বিবর্ণতা
যাক চলে দোল পূর্ণিমাতে


*জল বাঁচিয়ে আর দূষণ প্রতিহত করে এই বসন্তোৎসবে এস সবাই রঙ ফিরিয়ে দিই এই পৃথিবীকে। শুভ হক...দোলযাত্রা।*

Thursday, March 5, 2020

তুর্কীতে চরকিপাক


ভারী আশ্চর্য মানসিকতা আমাদের, তাই না বাবা, বল? যখন একটি অপরিচিত মানুষের হাতে বাসের স্টিয়ারিং, দিল্লি রোড ধরে পাগলের মত এঁকেবেঁকে ঊর্ধ্বশ্বাসে বাস ছোটে….দিব্য আরামে ঘুমোতে থাকি। কতবার আচমকা বেখাপ্পা ব্রেকে মাথা ঠুকে যায় জানলায়, তাও ভ্রূক্ষেপ না করে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। যিনি চালাচ্ছেন, তাঁর এমনকি লাইসেন্স আছে কিনা তা'ও জানিনা! 

অথচ কিনা হাওয়াগাড়িতে চড়ার হলেই তার হাল হকিকত জানতে লেগে যাই। যে Aircraft উড়বে তার বয়স, Technical specifications, flying record… Airline এর inflight service, dining option, review….আরো কত্ত কী!!! 

ঠিক তেমনই, এবারে ইস্তানবুল যাওয়ার আগে তার খোঁজপাত্তা নিতে যা সময় ব্যয় করলাম, সান্দাকফু যাওয়ার সময় অতটা করেছিলাম কি?   

কবি যেমন নদীর মধ্যে দাঁড়িয়ে উঠে প্রাণপণে দুই পাড়কে বাঁধেন, ঠিক তেমনি ইস্তানবুল তার প্রবল আকর্ষণে বেঁধেছে বস্ফরাস প্রণালীর দুই তীরে য়ুরোপ আর এশীয় মহাদেশকে। দুই মহাদেশ ব্যপী শহর পৃথিবীতে আর আছে বলে জানা নেই আমার।
দেড় কোটি নাগরিকের বাসভূমি এই শহর য়ুরোপের বৃহত্তম! আবার মে মাসের শুরু থেকে এখানেই খুলেছে পৃথিবীর বৃহত্তম বিমানবন্দর! এর প্রাচীণ নাম ছিল Constantinopole বা Byzantine...মিশ্র ধর্মীয় সংস্কৃতির আভাসটা সেখানেই পাওয়া যায়। ইস্তানবুলের ইতিহাসে তাই একাধিক সভ্যতার ঋদ্ধ প্রতিফলন। 

কলকাতা থেকে সাড়ে পাঁচ ঘন্টার রাস্তা দোহা হামাদ বিমানপত্তন। এখন পাকিস্তান আকাশপথ বন্ধ বলে একটু বেশি ঘুরপথে যেতে হয়। ভারতের পশ্চিম উপকূল দিয়ে বেরিয়ে আবার উত্তর দিকে উড়ে যেতে হয়।  ভোর হল অনেক্ষণ ধরে, তবে উত্তর পূর্ব উপকূলবর্তী এশীয় দেশগুলির দিকে আকাশপথে যাওয়ার সময় যে Oriental Sunrise দেখা যায়, তার রঙের স্ফুরণ নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। 
দোহাতে নেমে চারপাশে না তাকিয়ে দৌড় দিতে হল ঊর্ধ্বশ্বাসে। পরবর্তী উড়ান মাত্র ১ ঘন্টার তফাতে। আমার শহর থেকে কাতার এয়ারলাইনসের এই উড়ানটি থেকে ৯০ শতাংশ যাত্রীই চলেছেন য়ুরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রে আর প্রায় সকলের পরবর্তী উড়ানই খুব অল্প সময়ের মধ্যে। কিন্তু চমৎকার সময়ানুবর্তিতা আর Transit system এর ফলে সকলেই দিব্য connecting flight ধরে ফেলছেন অনায়াসে। 

আর হ্যাঁ,  Oryx Comm এর দৌলতে ১ ঘন্টার নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট পরিষেবা বিনামূল্যে পাওয়াটা একটা বড় আকর্ষণ কাতারের বিমানে। ৪১৭০০ ফুটের উচ্চতা থেকে প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারা টা নিঃসন্দেহে এক অবিস্মরণীয় প্রাপ্তি। মেয়ে যারপরনাই খুশ। কেবল “মাত্র ৮ এম বি” তে তার আপত্তি। বাবা কেবল খুব সন্দিগ্ধ আর চিন্তিত হয়ে লিখলেন : “থাকনা….কি দরকার অত উঁচু থেকে এইসব….নীচে নামতে তো আর আড়াই ঘন্টা, তারপর না হয় হবে…আর, এর পরের রাস্তায় তো নতুন দেশের হাতছানি; দেখবি, দেখাবি, না কেবল ফোনই টিপে যাবি?"


দোহা পর্যন্ত এসেছি Dreamliner Boeing 787-8 এ চড়ে। এখান থেকে আরো বড়  Boeing 777 ER নিয়ে যাবে ইস্তানবুল সাড়ে চার ঘন্টার উড়ানে। এই প্লেনটির পেটের মধ্যে ৩-৪-৩ আসন বিন্যাসের পরেও হাত পা ছড়ানোর জায়গা অনেক বেশি। সামনের টি ভি পর্দার আকৃতি আর ঔজ্জ্বল্য বলে দেয় যে বিমান Asian থেকে European sector এ ঢুকতে চলেছে। আর এখানেই আমার প্রবল আপত্তি। পরিসংখ্যান স্পষ্ট বলছে যে ভারতবর্ষের প্রায় যে কোন শহরে কাতারের বিমান প্রায় সব সময় ভর্তি। সেখানে য়ুরোপের বিভিন্ন গন্তব্যে গড়ে ৭০ শতাংশ আসন ভর্তি থাকে। অথচ সুযোগ সুবিধে জাঁকজমক সবই বেশি য়ুরোপগামী উড়ানে। কেন রে বাবা?

দিল্লি থেকে আলমাটি যাওয়ার আকাশপথ আর তুরস্ক যাওয়ার রাস্তা খানিকটা একই। তাই এই পর্যায়ে আবার দেখা হল হিন্দুকুশ পর্বতমালার সঙ্গে। তবে গ্রীষ্ম বলে তাদের গায়ে বরফের আস্তর কম। এটা ঠিক পোষালো না বাবার…."আচ্ছা বাজু, পাহাড়ের কি নিজস্ব কোন পাথুরে সৌন্দর্য নেই? তাকে সবসময় বরফের চাদর মুড়ে সঙ সেজেই তোদের মন পেতে হবে? পাথরের রঙের সঙ্গে নানান সবুজের এই যে অদ্ভুত ফ্রেস্কো, তাতে তোদের চোখ আটকায় না, তাই না?" ভাবলাম, সত্যিই তো! ইরান উপত্যকার ধোঁয়াটে পাহাড়গুলো কি কম মায়াবী? হেমন্তের শেষে আল্পস পর্বতমালার যে তুষারবিহীন রূপ দেখেছিলাম, তা কি কম মনোরম? বর্ষায় নীলগিরিতে সবুজের সমারোহ বা সিকিমের অবিশ্রান্ত ঝর্ণার সৌন্দর্যের কি কোন তুলনা হয়? 

বিমান যখন অবতরণ শুরু করলো, তখন একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হল আমার। অনেক বছর আগে প্রথম যখন বিদেশযাত্রার সুযোগ পেয়েছিলাম, তখন দল ছিল ৮০ জনের। হৈ হল্লার মধ্যে মনেই হয়নি নিজের দেশের সীমানা ছাড়িয়ে চলে এসেছি। তারপর গত নভেম্বরে তাইপেই গেলাম শুধু আমি আর এক সহকর্মী...মন্দের ভালো। কিন্তু এবারে আমি এক্কেবারে একা। এমনিতে আমি বাইরে গেলে বরাবরই একটু দলছুট। কিন্তু হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে এভাবে এক্কেবারে একা আর কখনো আসিনি। বয়স আর অভিজ্ঞতা বোধহয় এভাবেই একা করে দেয়।    

নতুন ইস্তানবুল বিমানপোত তেমন দাগ কাটলো না মনে। বিশালতার কারণেই হয়ত এখনো তেমন জীবন্ত হয়ে উঠতে পারেনি…. অভিবাসন প্রক্রিয়ার কাউন্টারে অফিসার ভদ্রলোক চেয়েই দেখলেন না আমার দিকে। লোটাকম্বল নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যে তরুণ তুর্কীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হল, তার নাম সুলেমান। বছর পঁচিশের ঝকঝকে তরুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর পাঠ শেষ করে বুঝতে পারেন এ'দেশে সাংবাদিক শব্দটা একটা অর্থহীন প্রহসন….অতএব এখন তিনি একজন Happy Transfer Man….পর্যটকদের সঙ্গে মিতালী করে নিজের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ভুলতে চান…"কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউসে, কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়"। মনটা কেমন ভার হয়ে উঠলো। 

বিমানবন্দরের বাইরে "বাম্পার" চমক। এক বিশাল কালো গোদা (আজ্ঞে হ্যাঁ, চিরাচরিত লম্বা নয়) মার্সিডিজে আমার মালপত্র তোলা হচ্ছে দেখে আমি হাঁচোড়পাঁচোড় করে আমার পরিচয় দিতে গেলাম। এই ভিনদেশে ঐ একখানি বাক্স সম্বল….কার গাড়িতে তুলে দিচ্ছে কে জানে রে বাবা! 
কিন্তু না, আমার উদ্যোক্তারা জানাল যে গাড়ি আমারই জন্য। অগত্যা….ছ'জন যাত্রী বহনে সক্ষম গাড়ির এক কোণে বসে চললাম মূল শহরের উদ্দেশ্য। আমার মধ্যবিত্ত মানসিকতায় ভারী এক অপচয় মনে হল আমার এই বিলাসিতা কে। আর একটা সত্যি বলি? রাস্তাঘাট মসৃণ আর তাই গাড়ির চলন ও। এতদব্যতীত আহা উহু করার কিস্যুই নেই এই গাড়ির দেখনদারি বাদ দিলে। বেঁচে থাক আমার Wagon R…. গাড়ির ভেতর থেকে ইস্তানবুল শহরগামী রাস্তাটা বড় ঊষর আর নিষ্প্রাণ লাগলো। তুমি বারবার মানুষজনের কথা জানতে চাইছিলে...তা সেই তারা রাস্তায় বাড়ন্ত। ইতালির মাপেনসা শহরের মত। মাইলের পর মাইল রাস্তায় শুধু গাড়ি ছাড়া জনজীবনের আর কোন চিহ্ন নেই। শহর ইস্তানবুলের উপকন্ঠে Hilton Bomonti তে আমার পরিযায়ী আস্তানা। আর পাঁচটা হোটেলের মতই। কিন্তু হোটেলে ঢুকতেই যেটা নজর কাড়ে তা হল লবিতে রাখা Shoe Polish Station….জন্মে ইস্তক কালো খয়েরী আর তার আশেপাশে গোটা পাঁচেক রঙের জুতো দেখেছি। আর এই জুতো পালিশের আখড়ায় কাঁসার তৈরী সুদৃশ্য গম্বুজাকৃতি সব কৌটোয় দু ডজন পালিশ!!! দেখেই তাক লেগে যায়। অথচ য়ুরোপীয় শহরগুলো সাধারণত এত পরিচ্ছন্ন, জুতো পালিশের প্রয়োজনই পড়ে না প্রায়। 

মালপত্র ঘরে পৌঁছে চটপট খেতে চলে গেলাম। লোভে লোভে ভেবেছিলাম নানাবিধ উপাদেয় তুর্কি রান্না চাখতে পারব। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখলাম তেমন কোন বিশেষ পদ নেই। পরিচিত রান্নার পাশে Turkish Meat Ball চোখ টানলেও জিভে তেমন দাগ ফেলল না।       

ইস্তানবুল নামটা N দিয়ে হলেও এখানকার লোকজন কিন্তু বেশি 'ম' আর কম 'ন' এর মাঝামাঝি একটা উচ্চারণ করে। দেশের ৯০ শতাংশের বেশি ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও একটা স্পষ্ট পার্থক্য চোখে পড়ে। অবশ্যম্ভাবী বিতর্কের ভয়ে বিশদে যাব না। তবে এরাই ধার্মিক। এদের সঙ্গে আমার সেই ভাই, বোন আর বন্ধুদের মিল পেলাম, যাদের বাড়ি ঈদে বা শবেবরাতে বিনা নিমন্ত্রণে পৌঁছে যেতে পারি। অন্যান্য জায়গার মত এখানেও ভারতীয় জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য। বাঙালীর সংখ্যাও। তবে বাংলাদেশি বাঙালির জনঘনত্ব এখানে আমার দেখা বিদেশভূমির মধ্যে সর্বাধিক মনে হল। আর কি তীব্র আকর্ষণ তাদের পশ্চিমবঙ্গের প্রতি। আমরা যেদিন পা রেখেছি, দেশে সেই দিনই লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা হচ্ছে। কিন্তু ভারতবর্ষ নয়, এরা প্রত্যেকে জানতে চায় শুধু পশ্চিমবঙ্গের খবর। 
কারণ? নতুন দেশ দেখার আনন্দে বোঝার চেষ্টা করলাম না। কিন্তু…. মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন রয়েই গেল, যার উত্তর খুঁজলে রাতের ঘুম উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।

নতুন জায়গায় নতুন সময়বন্ধে পৌঁছে শুনি লোকের "জেট ল্যাদ" হয়….আমার হয় উল্টো। মনে হয় অসময়ে ঘুমিয়ে পড়লে শরীর যে শুধু আরো অবসন্ন হয়ে পড়বে তাই নয়, একটা গোটা দিন চলে যাবে আঙুলের ফাঁক গলে। তাই ঘরে পৌঁছে স্নান সেরে আবার নিচে ফিরে এলাম। হোটেল থেকে আমারই মত কিছু পাগলের জন্য গাড়ি ছাড়ছে নগর পর্যটনের উদ্দেশ্যে। চড়ে পড়লাম। জ্বালা করা চোখ জ্বলে উঠলো নতুন দেশ দেখার আনন্দে।

আমরা প্রথম চলেছি harbour front এ...উদ্দেশ্য গ্র‍্যান্ড বাজার নামক বিপণি, যেটা নাকি Turkish delight এর সবচাইতে বড় খোলা বাজার। যার বিশ্বজোড়া খ্যাতি বাখলাওয়া বলে, সেই Turkish delight এর অপর স্থানীয় নাম লোকুম। মধু আর কাগজিবাদাম, কিশমিশ আর নানাবিধ মনভোলানো অস্বাস্থ্যকর উপাদানের সংমিশ্রণে তৈরী এই মিষ্টি মধুর বদলে চিনি দিয়েও তৈরি হয়, কিন্তু তা ঠিক খাঁটি তুরীয় তুর্কিষ্ঠান্ন নয়। বাস গেল শহরের ব্যস্ত রাস্তাঘাট ঘুরে বিকেলের মিঠে রোদ গায়ে মেখে নাম না জানা রাস্তায় অচেনা মানুষজনের সঙ্গে নীরব আত্মীয়তা করাতে করাতে। বাবাকে জানাতে বাবা বললেন, "যাক, মিষ্টির লোভ ছাপিয়ে মানুষজন যে দেখতে পাচ্ছিস এতেই খুশি হলাম...রুমির বাড়িটা খুঁজে পাস কিনা দেখিস তো….Out beyond ideas of wrongdoing and rightdoing there is a field. I'll meet you there. When the soul lies down in that grass the world is too full to talk about…..”, বাবা হারিয়ে গেলেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর সুফি কবির সঙ্গে। রুমির একটা লাইন বাবার কাছেই শুনেছিলাম… বড় সরল আর সুন্দর…"তোমার শরীরের প্রতিটা আঘাতই তোমার জীবনে জ্ঞানের আলো ঢোকার রাস্তা তৈরী করে দেয়".... I died as a mineral and became a plant, I died as plant and rose to animal, I died as animal and I was Man. Why should I fear? When was I less by dying?.... তুর্কির সাহিত্যস্রষ্টাদের মধ্যে রুমিই সবচেয়ে বেশি অনূদিত আর পঠিত। এমন সহজিয়া কথাবার্তা তুর্কি তো নয়ই, পারস্য প্রদেশের অন্যান্য সাহিত্যিকের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ধর্মীয় গোঁড়ামিও রুমির লেখায় এক্কেবারে অমিল।

Grand Bazaar এর উল্টোদিকে Grand Palace… ছোট্ট এক পোতাশ্রয়ের কোল আলো করে। মাতাল করা নীল আকাশ আর ঝকঝকে রোদ্দুর মনটাকে ভীষণ ভালো করে দিল হঠাৎ। সক্কলের সঙ্গে মূল বাজারে না ঢুকে বাইরের চাতালে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের " খোলা" বাজারে ঢুকলাম তাই। আর ঢুকেই চমকের পর চমক…. "দাদা কি বাংলাদ্যাশি?" এক বছর পঁচিশ ছাব্বিশের তরুণ….বাংলাদ্যাশি নই, তবে বাঙাল…. জানানোর পরের প্রশ্ন আরো চকমকপ্রদ… "দিদি জেতলো? আমার তো মুদীরে পছন্দ নয় এক্কেরে…" ২০১৭ থেকে জীবিকার সন্ধানে রাজশাহী থেকে এখানে। এ'ও রুমি। এক্রামুল আহসান রুমি। তুর্কী মিষ্টি কিনতে কিনতে কত কথা, কত গল্প...যেন কতদিনের চেনা। বললাম দেশের খবর কি? কিঞ্চিৎ মৃয়মান হয়ে বলল, "আর কি দাদা? হাসিনা আওনের ফরে আমরা আর হাসি না"....

বাজারের ভেতরের স্থাপত্য ও সজ্জা খানিক পার্সি আর খানিক মোগলাই ধরণের। বাজারের এক অংশে মূলতঃ শুকনো ফল আর মশলা। আর অন্য ভাগে মূল আকর্ষণ মিষ্টি….বাখলাওয়া!!  আর এই বাজারের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি দোকান হল বিখ্যাত হাজের বাবা গোষ্ঠীর। প্রত্যেক দোকানে একজন মুখ্য ভট্ট আছেন যিনি মিষ্টির পাকপ্রণালী বুঝিয়ে বলছেন আর তারপরে আস্বাদন করানো হচ্ছে। সঙ্গে জাফরান মিশ্রিত চা। মিষ্টিগুলো সত্যি জীবনের মানে পাল্টে দেওয়ার মতো। খানিকটা মিল আছে অস্ট্রেলিয়ার ন্যুগাট বস্তুটির সঙ্গে। পরে কলকাতার একমাত্র বাখলাওয়ার দোকানে গিয়ে দেখেছি, এই অমৃতের ধারেকাছে নয় তার স্বাদ। অতঃপর বিপুল পরিমাণ তুষ্টি (তুর্কী মিষ্টির এই চমৎকার নাম সঙ্কোচ টা এক সহকর্মী বললেন) বাক্সবন্দী করে, কাঁধে ওজন বাড়িয়ে ও পকেটের ওজন কমিয়ে বেরোনো গেল গ্র‍্যান্ড বাজার থেকে। বাজারের প্রাধান দ্বারের কাছে কাঠির মাথায় বিশেষ আইসক্রিমের জন্য ভীড়ে হঠাৎ কেন জানি মায়ের কথা মনে পড়ল। দশ পয়সার কাঠি আইসক্রিম স্কুল ফেরতা কত কিনে এনেছি….একটাই আইসক্রিম ভাগ করে খেয়েছি দু'জনে….তার স্বাদ এর চাইতে অনেক ভাল ছিল, আস্বাদ না করেও বলতে পারি আমি। 

বাস আমাদের এবারে নিয়ে চলেছে নৈশভোজে। ঘড়িতে স্থানীয় সময় সন্ধ্যে ৭টা আর সূর্যদেব এখনো দিব্যি দৃশ্যমান। বুঝলাম, রাতে ঘুম ভাঙবে খিদের কামড়ে। যথাসম্ভব ধীরে খেতে হবে। যতটা রাতের দিকে গড়িয়ে যাওয়া যায় আর কি।

Golden Horn estuaryর পাড়ে এক ভারতীয় রেস্তোরাঁয় আয়োজন রাতখাবারের। ভারী মনোরম এক খোলা বারান্দায় বসলাম স্বর্ণশৃঙ্গ নামক মোহনার মুখোমুখি। শহরের মধ্যে দিয়ে উজান বওয়া এই মোহনাটি বস্ফরাস প্রণালীর প্রবেশপথ। ভারী তাৎপর্যপূর্ণ এর ভৌগোলিক অবস্থিতি। বস্ফরাস প্রণালী যেখানে মারমারা সাগরে লীন হয়েছে, তার একটি অংশ Byzantine ও Constantinople এর ইতিহাস সমৃদ্ধ প্রাচীন ইস্তানবুল উপদ্বীপের  উত্তর সীমান্তরেখা গঠন করে একটি শৃঙ্গসদৃশ পোতাশ্রয় গঠন করেছে। যেন সযত্নে আড়াল করেছে ইস্তানবুলের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে, তার আধুনিকতা থেকে। দুই শতাধিক বছর বা তারও বেশি সময় ধরে এই রাস্তা দিয়েই গ্রীক, রোমদেশিয় আর ওটোমান বাণিজ্যতরী পৌঁছে গেছে ইউরোপের মধ্যে। আমি ঠিক যেখানে বসে তাকিয়ে আছি সামনের সুপরিসর জলরাশির দিকে, ঠিক সেখান দিয়েই হয়তো বা হেঁটে গেছে রোমান বণিক অথবা গ্রীক সেনানী অথবা পর্তুগিজ নাবিক। তাদের আমি চিনি না। তারাও চেনে না আমাকে। কিন্তু এই যে আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে সূর্যাস্তের আলোয় একেবারে মন মাতাল করা সোনা রঙ ধরছে জলে আর তটভূমিতে...সেই দৃষ্টিতে আমরা সহস্রাধিক বছরের ব্যবধান মিটিয়ে মুগ্ধতার আত্মীয়তায় এক হয়ে গেছি এই মুহূর্তটিতে। চারপাশে বহু মানুষ আমার। এতক্ষণ তাদের বিশ্রম্ভালাপে জায়গাটা কফি হাউস মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন প্রকৃতির এই অবিশ্বাস্য অসামান্য উদ্ভাসে সবাই এক্কেবারে নিশ্চুপ। বড় অদ্ভুত এই বোধ। সূর্যাস্তের এই  বর্ণচ্ছটায় কারো মন আনন্দে নিমগ্ন….কারও বা মন জেগে উঠছে ঘোর দুঃখে...কারও কাছে এই রূপ জাগিয়ে তুলছে প্রাপ্তিসুখের উল্লাস, আবার কাউকে সব হারানোর বেদনায় করছে ভারাতুর। কতক্ষণ এই নৈঃশব্দের আশীর্বাদধন্য ছিলাম জানিনা; ঘোর কাটলো অসংখ্য ক্যামেরার শাটার পড়ার শব্দে। আমার কেন জানিনা ছবি তুলতে মন চাইল না। আমার মন যা দেখল আমার চোখই ত দেখতে পেল না, তা ক্যামেরার চোখ আর কিই বা দেখবে? জানি না আর কখনো এই জায়গায় বসে এই স্বর্ণালী সন্ধ্যা দেখার সৌভাগ্য হবে কিনা; তবে স্মৃতির গভীরে যে বন্ধনে একে বাঁধলাম, তা এ জন্মে আর হারিয়ে যাওয়ার নয়।

Golden Horn থেকে বেরিয়ে বাসে করে যখন হোটেলে ফিরে এলাম, তখন রাতের মায়াবী আলোয় শহরটা অন্যরকম… কিন্তু আমার চোখে তখন রাজ্যের ঘুম….


কনফারেন্স সমাধা করে তৃতীয় দিন দেখতে গেলাম ইস্তানবুলের দুই মূল ঐতিহাসিক আকর্ষণ।

 আয়া সোফিয়া নামটি আসলে গ্রীক, যার মর্মার্থ পবিত্র মহাজ্ঞান। এটির পত্তন হয় ৫৩৭ খ্রীষ্টাব্দে প্রাচীন সনাতন গোষ্ঠীশাসিত গীর্জা হিসেবে। পরবর্তীকালে যা তুরস্কপ্রবাসী সার্বভৌম মসজিদ মন্ডলে অধিকৃত হয়। এখন এটি জাতীয় যাদুঘর। তৎকালীন বিশ্বের বৃহত্তম আধুনিক স্থাপত্য আয়া সোফিয়া বিখ্যাত ছিল তার মিনারগুলির জন্যও। Byzantine স্থাপত্যরীতির প্রতিফলন এই মসজিদ তথা গীর্জাটির দেওয়ালে দেওয়ালে চমক। মা মেরী ও যীশুর পাশে হাদিসের ফ্রেস্কো...প্রার্থনাঘরের বেঞ্চির সামনে নমাজের বেদী। ওটোমান আগ্রাসনে ধর্মীয় পট পরিবর্তন হলেও, উত্তর আধিকারিক কি অবিশ্বাস্য মমতায় পূর্বসূরির আবেগ আর বিশ্বাসকে সযত্নে রক্ষা ও লালন করেছে তা ভাবলে আশ্চর্য লাগে...সারা বিশ্বের কাছে ধর্মীয় গোঁড়ামি আর সঙ্কীর্ণতার বিরূদ্ধে আয়া সোফিয়া এক মহামূল্যবান শিক্ষা।  

আয়া সোফিয়া থেকে দৃষ্টি ছোঁড়া দূরত্বে Sultan Ahmed Mosque, যা Blue Mosque বলে বেশি পরিচিত। ১৬০৯ থেকে ১৬১৬র মধ্যে নির্মিত মসজিদটি আজও একটি মাদ্রাসা ও প্রার্থনাস্থল নিয়ে পূর্ণমাত্রায় সক্রিয়। ব্লু কেন? হাতে তৈরী আর রঙ করা নীল রঙের টালিতে সজ্জিত এর অভ্যন্তরটি। তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সন্ধ্যের পরে স্বপ্নিল রঙের আলোয় স্নান করানো ব্লু মস্ককে বহু মাইল দূর থেকে চেনা যায়। গোল্ডেন হর্ণের সোনালী সূর্যাস্ত নিভে গেলে ইস্তানবুলের দিগন্তরেখায় ৬টি সুদীর্ঘ মিনারে সজ্জিত  এই সুনীল স্থাপত্যটি যেন দৃপ্ত এক দিকনির্দেশ।     

 আমাদের পরের গন্তব্য টপকাপি প্রাসাদ। সুলতান মেহমেদের আদেশক্রমে, রোমান শাসনকে পরাস্ত করার ৬ বছির পরে ১৪৫৯ এ শুরু হয় এর নির্মাণ। মূলতঃ প্রশাসনিক কার্যালয় হিসেবে গড়ে ওঠা এই প্রাসাদটি একবার ভূমিকম্প ও আর একবার বিধ্বংসী আগুনে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে ১৮৫৬ তে প্রশাসনিক কাজকর্ম স্থান পায় নতুন প্রাসাদে, যার নাম Dolmablanche Palace আর ১৯২৩ এ পাকাপাকিভাবে এটি যাদুঘরের আখ্যা পায়। চার মহলা প্রাসাদে যা নিয়ে প্রদর্শককে সবচেয়ে উত্তেজিত মনে হল তা হল হারেম। কুশীলবের অনুপস্থিতিতে নিষ্প্রাণ মঞ্চের মত যা এখন কেবলমাত্র একটি ইট কাঠ পাথরের নির্মাণ মাত্র।

ইতিহাসে পাতিহাঁস আমার এবারে মাথা বনবন করছিল। বাকি ইতিপিপাসু লোকজনকে ত্যাগ করে আমি এবার একটু খোলা আকাশের তলায় যেতে চাইছিলাম। বেরিয়ে এসে তাই চললাম অদূরে Sultanahmet Square এর উদ্দেশ্যে। সুলতানাহমেদ চক আমাকে অভ্যর্থনা করল ঝকঝকে আকাশের তলায়। একদিকে ফুলের পসরা…. চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুলের মতই নানান রঙের নানান মনের মানুষেরা। চকের কেন্দ্রে তিনটি দ্রষ্টব্য মিনার… The Egyptian Obelisk, Serpentine column ও The Colossus…. Byzantine সাম্রাজ্যে এই জায়গার নাম ছিল Hippodrome… Constantinople এর ক্রীড়াক্ষেত্র ও বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। কত ঘোড়দৌড়, তীরন্দাজি আর অস্ত্র প্রতিযোগিতার সাক্ষী এই জায়গা। কত বিজয়ীর কত উচ্ছ্বাস, কত বিজিতের দীর্ঘশ্বাস আর আহতের রক্তাক্ত আর্তনাদে সম্পৃক্ত এই রঙ্গভূমি। গা শিরশির করে উঠল যেন….বিকেলের ঠান্ডা হাওয়ায়, না পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া অশরীরী ঘোড়সওয়ারের গতির দাপটে, বুঝতে পারলাম না…

আমার, বা আমাদের দিনান্তের গন্তব্য এবারে সুবিখ্যাত টাকসিম স্কোয়ার।  ইউরোপের আর সব শহরের মতই এটিও ইস্তানবুলের Central square….Galata Bridge ধরে বস্ফরাসের ওপর দিয়ে গাড়ি চলল আমার সঙ্গে Galata Tower আর সুলেমানিয়ে মসজিদের এর পরিচয় করিয়ে।

আমস্টারডাম বা মিউনিখের তুলনার কিঞ্চিৎ স্বল্পপরিসর এই জায়গাটি। এরও কেন্দ্রস্থিত একটি স্থাপত্য। ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই Republic Monument, তুর্কী প্রজাতন্ত্রের আত্মপ্রকাশের সোচ্চার স্মরণ। টাকসিম জায়গাটিও ভারী প্রাণবন্ত। আর, হবে নাই বা কেন? যেখানে টাকসিম চকের শেষ, সেখানেই শুরু ইশতিকলালের! ইশতিকলাল স্ট্রীট হল যাকে বলে ইস্তানবুলের সবচাইতে hot and happening জায়গা। "ইশতিকলাল লোকটা কে?" বাবার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানলাম এর মানে স্বাধীনতা সরণি।  তাইই বটে...প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ লক্ষ লোক আসে এই ইশতিকলাল সরণিতে, স্বাধীনভাবে, নিজের মত কিছু সময় কাটাতে। টাকসিমের দিক থেকে সোজা তাকালে অপর প্রান্ত পর্যন্ত দৃষ্টি পৌঁছয় না, এতটাই লম্বা ইশতিকলাল। হাঁটতে শুরু করলে নেশা ধরে যায়...ধর্মতলা-চৌরঙ্গী-গড়িয়াহাটের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু সেসবই মূলতঃ বিকিকিনি আর খাওয়াদাওয়ার জায়গা। কোথাও সঙ্গে সিনেমা। কিন্তু ইশতিকলাল স্ট্রীট জুড়ে গোটা তুর্কী দেশটাই যেন ফুটে উঠেছে। কোথাও আত্মভোলা কিশোরের দারবুকায় লহরার সঙ্গে তরুণ-তরুণীদের নাচ, কোথাও বা নাট্য আকাদেমীর সামনে ছাত্রদের পথনাটিকা। কোথাও তুর্কী আইসক্রিমওয়ালার হাতের ভেলকি, আবার কোথাও বাখলাওয়া বানানোর হাতেকলম শিক্ষার ক্লাস রাস্তার উপরে। আর সব ছাপিয়ে….নানা রঙের নানা চেহারার নানান ব্যক্তিত্বের নানা সংস্কৃতির…. "মানুষ মানুষ, শুধুই মানুষ"। কিন্তু এদের মধ্যেও আছে হেঁটে যাওয়া সেই মুখ, আজ " জ্বলেনি যার ভাতের হাঁড়ি"...দেখে বোঝার উপায় নেই শুধু। দু'চোখ ভরে এদের আস্বাদন করতে করতে কখন যে এসে পড়েছি রাস্তার শেষ প্রান্তের ট্রাম গুমটিতে...ঘড়ি বলছে কেটে গেছে প্রায় ৫০ মিনিট, অথচ ক্লান্ত লাগছে না একটুও। শুধু মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠছে এই ভেবে যে কালও এই ইশতিকলাল স্ট্রীট এইরকমই মানুষের স্রোতে উত্তাল হয়ে উঠবে….এই সুর ছন্দ বর্ণ আবেগ একইরকম স্বপ্নময় আবহ তৈরী করবে এর কোণায় কোণায়...সব থাকবে, সবাই থাকবে….থাকব না শুধু আমি। কে বলতে পারে, এই রাস্তায় এটাই আমার শেষ চলা নয়?

শেষ দিনের দ্বিতীয়ার্ধে আমাদের বিদায় উৎসবের আয়োজন ছিল বস্ফরাসের ওপরে এক ছোট্ট রেস্তোরাঁয়….ইস্তানবুল থেকে জলপথে প্রায় ৭৪ মাইল দূরে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার সময় রওনা হওয়া গেল। যদিও এ পথে ইস্তানবুল থেকে কৃষ্ণসাগরের দূরত্ব ৬৭০ কিলোমিটারের বেশি, তবু আমাদের জাহাজ যত এগোচ্ছে জলের চরিত্র দৃশ্যতঃ পাল্টে যাচ্ছে… ভারী থেকে গাঢ়তর জল কেটে আমরা এগিয়ে চলেছি একটার পর একটা সেতুর তলা দিয়ে। এই ব্যপারটা আমাকে কোনকালেই খুব একটা স্বস্তি দেয়না….চেনা কে পেছনে রেখে রহস্যময় অজানার দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই অভিযাত্রী মনের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু এই যে আমার সামনে অনন্ত জলরাশি, যার সামনে আর দু'পাশটা আমার সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা….যার ওপরের ঘন নীল আকাশ বা নীচের কালচে নীল জলের কেবল রঙটুকু বাদে আর সবই রহস্যাবৃত, তার চেয়ে পেছনে ফেলে আসা ইস্তানবুল আয়া সোফিয়া আর ইশতিকলালই আমাকে টানে বেশি। অথচ দৃষ্টির ওপারে যে অচেনা, তার হাতছানিও এড়াতে পারি না…ঠোঁট উল্টিয়ে সে বলে ঃ ইস্তানবুলকে আগে চিনতে বুঝি? এত হাজার মাইল পেরিয়ে সেখেনে এসে পড়তে পারলে, আর আমি হলেম অচেনা? এসো, চিনে নিতে কতক্ষণ? অস্বীকার করতে পারি না...যে সেতুর তলা দিয়ে এইমাত্র এলাম, সে আমার পরিচিত হল। সামনের সেতুটি, যেটি এখন পড়ন্ত সূর্যের আলোয় সোনালী হাতছানিতে ডাকছে আমাদের, সে এখন আমার অচেনা। তাকে কিন্তু আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমার বন্ধু করে নেব...তবে আর "অচেনাকে ভয় কি আমার?" জাহাজের ডেকে কাচের সুদৃশ্য হাতলবিহীন স্বচ্ছ্ব তুর্কী পেয়ালায় চা খেতে খেতে এভাবেই অতলান্ত কৃষ্ণসাগরের পথে ভেসে যেতে যেতে শরীরে কাঁটা দিল। আর কয়েক ঘন্টার মধ্যে বিদায় জানাব ইস্তানবুলকে। ফিরে যাব আমার প্রিয় মানুষ, প্রিয় গাছ পাতা পাখিদের সান্নিধ্যে। হয়ত কখনোই ফেরা হবে না আর, বা ফিরলেও মন দৃষ্টি অনুভূতিগুলো আলাদা হয়ে যাবে। কিন্তু আমার ফেরারী মনের সঙ্গে এই Eurasian transcontinental এর সামান্য ক'দিনের সখ্যতা কি স্বমহিমায় অমূল্য এক অধ্যায় হয়ে থাকবে না আমার জীবনে? তাইই কি কম? এই কটা দিনের আত্মীয়তাকে আমি সঠিক মূল্য দিতে পারলাম তো? পারলাম তো ইস্তানবুলকে চিনতে? আমার চলে যাওয়ার পরে একটা খন্ড মুহূর্তেও কি ইশতিকলালের সেই ল্যাম্পপোস্ট টা আমাকে স্মরণ করবে? যদি করে,কিভাবে করবে? ভৌগোলিক অবস্থানের জন্যই বোধ করি, আধুনিক তুর্কী সাহিত্যের প্রবক্তা নাজিম হিকমতের একটা বিখ্যাত কবিতা মনে পড়ে গেল….

I renounced from being part of the earth,
I renounced from being a flower
to be able to stay with you.
And I am becoming dust,
to live with you.
Later, when you also die,
you'll come to my jar.
And we'll live there together
your ash in my ash,
until a careless bride
or an unfaithful grandson
throws us out of there...
But we
until that time
will mix….. 

ভালবাসার সঙ্গে মিলেমিশে ছাই হয়ে উড়ে যাব….তখন ইস্তানবুল….তোমার সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে। এখনকার বিচ্ছেদ তাই হক বর্ণময়…. E L V E D A!













   

Tuesday, March 3, 2020

মে ২৩, ২০১৭

আমাদের মেঘেরা অত ব্যস্ত নয় তোমাদের মত
এখানের রঙ নয় তোমাদের মতন রঙীণ
বাঁধভাঙা মৃত্যুমুখ মিছিলের মাঝে ডোবে বলে
থ্যাঁতলানো বেঁচে থাকা পুষ্টিতে আরোতর ক্ষীণ